শুধু ‘সোনার খনি’ই নয়, মিরপুরের সেই বাড়ি ঘিরে রয়েছে আরও রহস্য!

রাজধানীর মিরপুরের একটি বাড়িতে সোনার খনি বা গুপ্তধনের সন্ধানে মাটি খুঁড়ছে প্রশাসন ও পুলিশ। বাড়িটির মাটির নিচে কমপক্ষে দুইমণ সোনা আছে এমন দাবি ওঠায় তথ্যটির সত্যতা নিশ্চিত করতে বাড়ির মেঝে খুঁড়ে দেখা হচ্ছে । দিনব্যাপী চলমান অভিযানে ওই বাড়ির সাতটি কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষের ভেতরের সাড়ে চার ফুট মাটি খনন করা হয়েছে। অবশ্য এখনো সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তার কারণে অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বেলা পৌনে ৪টার দিকে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ারুজ্জামান জানিয়েছেন, রবিবার আবারও অভিযান শুরু করা হবে।

গতকাল শনিবার (২১ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে মিরপুর-১০ এর সি ব্লকের ১৬ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িতে এই অভিযান চলছে বলে জানায় মিরপুর থানা পুলিশ। ঢাকা জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে খনন কাজ শুরু করে মিরপুর থানা পুলিশ। মিরপুর-১০ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ১৬ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বরের এই বাড়িটি দুই কাঠা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বাড়িতে কোনো ভাড়াটিয়া নেই।

বাড়ির নিচে ‘গুপ্তধন’, খবর দিলো কেঃ মিরপুরের ওই বাড়ির নিচে যে গুপ্তধন আছে, সে সম্পর্কে কেউই আগে থেকে কিছুই জানত না। এমনকি ওই বাড়ির বর্তমান মালিকেরও এই সম্পর্কে পূর্ব থেকে কোনো ধারণা ছিল না বলে জানিয়েছেন। ১০ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফ থানা এলাকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে মো. তৈয়ব নামে এক ব্যক্তি মিরপুর থানায় প্রথম একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

তৈয়ব জিডিতে উল্লেখ করেন, মিরপুরের ওই বাড়ির নিচে গুপ্তধন রয়েছে। আর বাড়ির মূল মালিকের নাম দিলশাদ খান। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান চলে গেছেন। বাংলাদেশে সৈয়দ আলম নামে দিলশানের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় রয়েছে। এই আলমও পাকিস্তানেই থাকেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে আসেন।

এই আলমই তৈয়বকে জানান, মিরপুরের ওই বাড়িটির নিচে দুই মণের বেশি স্বর্ণালঙ্কার ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে।

এরপর তৈয়ব ও আলম মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা সেই গুপ্তধন বের করতে টেকনাফ থেকে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু ঢাকায় আসার পরে তৈয়বকে কিছু না বলেই আলম একাই সেই গুপ্তধন খুঁজতে বাড়ির মালিকের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে। সে কারণে তৈয়ব মিরপুর থানায় হাজির হয়ে জিডির মাধ্যমে বিষয়টি পুলিশকে জানায়।

এই ঘটনার পরে এলাকায় বেশ আলোচনা শুরু হলে ওই বাড়ির বর্তমান মালিক মনিরুল আলমও ১৪ জুলাই মিরপুর থানায় একটি জিডি দায়ের করেন। সেই জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, তার বাসার মাটির নিচে গুপ্তধন রয়েছে বলে এলাকার লোকজনের মধ্যে নানা রকমের আলোচনা শুরু হয়েছে। সে কারণে তার ওই বাড়িটির সামনে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে। বাড়িতে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা জানিয়ে মনিরুল জিডিতে উল্লেখ করেন, বাসার মাটির নিচে গুপ্তধন রয়েছে কি না, সেটা দেখতে ওই বাড়িটি খনন করতে তার কোনো আপত্তি নেই। যদি সত্যি সেখানে কোনো গুপ্তধন পাওয়া যায়, তবে তা বেওয়ারিশ সম্পত্তি হিসেবে আইন মোতাবেক সরকারি কোষাগারে জমা করা হবে। মূলত বাড়ির মালিকের জিডির কথা উল্লেখ করেই পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর আদলতের আদেশে শনিবার সকাল থেকেই বাড়ির খনন কাজ শুরু করা হয়।

কীসের ভিত্তিতে এই অভিযান? তৈয়ব নামের সেই ব্যক্তির দেওয়া তথ্য নাকি শুধু এলাকার গুজব? কীসের ভিত্তিতে এত আয়োজন করে অভিযান চালানো হচ্ছে–এই বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন বলেন, তৈয়বের নামের সেই ব্যক্তির জিডি বা গুজবে নয়। এই বাড়ির মূল মালিকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই আদালতের নির্দেশে এই অভিযান চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাড়ির মালিক মনিরুল বলেন, ‘তৈয়বের নামের সেই ব্যক্তিকে আমি চিনি না। তবে এলাকায় যে গুজব ছড়িয়েছে, তাতে নিরাপত্তার জন্য ও মানুষের মনের সন্দেহ দূর করতে আমি পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলাম বাড়িটি খনন করতে। যদি কিছু পাওয়া যায়, তা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হবে।’

রাতের আঁধারে ওই বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টাঃ চলতি মাসের ১৩ জুলাই রাতে ওই বাড়িতে ৩-৪ জন অজ্ঞাত লোক জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল বলে দাবি করেছেন বাড়ির বর্তমান মালিক মনিরুল আলম। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এই বাড়িতে আমার দুজন কেয়ারটেকার থাকেন। গত ১৩ জুলাই রাতে ৩-৪ জন অজ্ঞাত মানুষ জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করে বলে কেয়ারটেকাররা জানিয়েছে। এরপরের দিনই আমি থানায় গিয়ে জিডি করেছি। ওই অজ্ঞাত মানুষেরা কেয়ারটেকারকে প্রলোভন দেখিয়েছে যে, বাড়ির নিচে গুপ্তধন আছে। এই বলে তাদের লোভ দেখিয়ে বাসায় ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের বাসায় ঢুকতে দেয়নি।’

‘গুপ্তধনের’ কথা আগে কোনোদিনই শোনেননি এলাকাবাসীঃ ওই বাড়ির নিচে যে গুপ্তধন আছে–এমন কোনো কথা গত ১০ দিন আগেও শোনেননি মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বাসিন্দারা। বরং ওই বাড়ির সামনে হঠাৎ পুলিশ মোতায়েন করার পর থেকেই বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। খনন করা বাড়ির ঠিক ১০০ গজ দূরের অপর এক বাড়ির বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাস করেন। এই বাড়ির দুই-তিন মালিকের হাত বদল হওয়া দেখেছেন বলে জানান আনোয়ার। তবে বাড়ির নিচে যে গুপ্তধন আছে, তেমন কোনো খবর আগে শোনেননি বলে দাবি করেন তিনি।

জরিনা বেগম ওই এলাকার ৬০ বছরের বয়স্কা এক নারী। তিনি বলেন, ‘বাবা এই ম্যালা দিন থাকি, কিন্ত এই বাড়িতে কীসের গুপ্তধন আছে, সেটা কোনোদিনই শুনি নাই। কয়েক দিন হয় মাইনষে কয় বাড়িডা নাকি পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, সেখানে নাকি ম্যালা সোনা আছে। তয় এমন কথা এই প্রথমবার শোনলাম।’ ১৬ নম্বর সড়কের মাথায় ওই বাড়ির কাছাকাছি চায়ের দোকানের একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আরে কীসের গুপ্তধন। এখানে কিছু নাই। কয় দিন হয় মানুষের ভিড় জমছে এই বাড়িতে। অবশ্য বাড়ির নিচে সোনা থাকুক বা না থাকুক, আমার ব্যবসা বেশ ভালোই হচ্ছে।’

৮ বছর আগে বাড়িটি কিনেছিল মনিরুলঃ বাড়ির বর্তমান মালিক মনিরুল আলম দাবি করেন, ২০১০ সালে সেলিম নামের এক ব্যক্তির কাছে থেকে তিনি বাড়িটি কিনেছেন। তবে এই বাড়ির মূল মালিক কে, সেটা জানেন না তিনি। শুধু জানেন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্লট আকারে এটি প্রথম মালিক কিনেছিল। এরপর কয়েক হাত বদল হয়ে তিনি কিনেছেন।

ছয় মাস ভাড়াটিয়া নেই ওই বাড়িতেঃ ওই বাড়ির মালিক মনিরুল ইসলামের বক্তব্য যদি সত্যি হয়, মাটির নিচে থেকে কিছু পাওয়া যায়, তবে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে বলে তিনি পুলিশের কাছে লিখিত দিয়েছেন। আর কিছু না পেলেও যেন এই ধরনের গুজবটি আর না থাকে।

সম্প্রতি কেউ কি বাড়িটি কিনতে চেয়েছিল কি না? আর সেটা নিয়ে কেউ এই গুজবটি ছড়াচ্ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘না, কেউ বাড়ি কিনতে চায়নি।’ বরং তিনি এখানে একটি বহুতল ভবন করবেন বলে গত ছয় মাস ধরে বাড়িটি ভাড়াটিয়া শূন্য রেখেছেন।

এই বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির বলেন, ‘বাড়িটি এখন পুলিশি হেফাজতে থাকবে। আগামীকাল আবারও খনন কাজ শুরু করা হবে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ মোতায়েন করা থাকবে।’

এর আগে বাড়িটিতে ‘গুপ্তধনের’ সন্ধান বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহম্মেদ জানান, ১৯৭১ সালে এই বাড়িটি একটি জল্লাদখানার মতো ছিল। কয়েক দিন আগে এই বাড়ির সেই সময়ের মালিকের একজন আত্মীয় থানায় এসে একটি অভিযোগ করেন। দুই পক্ষই বাড়িতে গুপ্তধন থাকার কথা জানিয়ে জিডি করায় পুলিশ বিষয়টি আদালত ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে জানায়।

এরপর আদালতের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বাড়িটিতে খনন কাজ শুরু হয় বলে জানান ডিসি।